সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০১৭

রাগ নিয়ন্ত্রণ !!! স্টেপ বাই স্টেপ প্রক্রিয়া

বর্তমান প্রজন্মের কিশোর ও তরুণদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পোস্ট...
রাগ খুবই স্বাভাবিক একটি আবেগ এবং এটি স্বাস্থ্যকরও, তবে যতক্ষণ এর ওপর তোমার নিয়ন্ত্রণ আছে তক্ষণই এটা ভাল। যখনি দেখবে রাগ তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন তোমার নিজেকে এবং আশেপাশের মানুষদের নিরাপদে রাখার জন্য তোমাকে একটা কিছু করতে হবে।
রাগ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তোমার যা যা জানা প্রয়োজন তার সবই এখানে বলা আছে। তুমি কিভাবে বুঝতে পারবে তোমার রাগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা আছে কি না? থাকলে কি করতে হবে, আর কি করা যাবে না?
তোমার কি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে সমস্যা হচ্ছে?
------------------------------------------------------------
যদি তোমার রাগ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়, তাহলে সবচেয়ে ভালো সাহায্য তুমি তখনি পাবে যখন সেটা স্বীকার করবে। তোমাকে এটা মেনে নিতে হবে যে তোমার রাগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং সেটাকে প্রতিহত করার উপায়ও তোমাকে নিজেকেই খুঁজতে হবে। তুমি নিচের প্রশ্নগুলো নিজেকে করে দেখতে পারো -
১। কেউ তোমার মতের বিরুদ্ধে গেলেই কি তোমার শান্ত থাকা কঠিন হয়ে পড়ে?
২। তোমার পরিবারের সদস্যরা কি তোমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলে, কিংবা তারা কি তোমার রাগ নিয়ে ভীত থাকে?
৩। প্রচণ্ড রাগের বশে কি তুমি জিনিসপত্র (যেমন, গ্লাস, টেবিল, চেয়ার, ছাইদানি ইত্যাদি) ভেঙ্গে ফেলো কিংবা দেয়ালে জোরে ঘুষি মারো বা কখনো মেরেছো?
৪। রাগের মাথায় তুমি কি কখনো কারো গায়ে হাত তুলেছো, চড় মেরেছো বা আঘাত করেছো?
৫। যদি তোমাকে কোনো কথার মাঝখানে থামিয়ে দেয়া হয় বা সমালোচনা করা হয়, তাহলে কি তুমি রেগে যাও?
৬। ধরা যাক, কেউ তোমাকে কিছু বললো বা এমন কিছু করলো যার কারণে তুমি অনেক কষ্ট পেলে কিন্তু সে সময় তাকে কিছু বললে না। পরে কি তুমি 'তাকে কি বলতে পারতে' বা ' তাকে তখন আসলে কি বলা উচিত ছিলো' সেটা ভেবে মনে মনে গজগজ করে সময় পার করো?
৭। কেউ যদি তোমার সাথে কোনো ভুল করে, তাহলে কি তুমি তাকে সহজে ক্ষমা করতে পারো না?
৮। যখন তোমার প্রচণ্ড রাগ হয়, কিংবা তুমি প্রচণ্ড হতাশ বা আহত বোধ করো তখলে কি রাগ প্রশমনের জন্য তোমার খাওয়া-দাওয়ার মাত্রা বেড়ে যায়, কিংবা তুমি কি অ্যালকোহল বা অন্য কোনো মাদক ব্যবহার করে নিজের রাগ কমাতে চাও?
৯। অনিয়ন্ত্রিত রাগের জন্য কি তোমার কাজের অসুবিধা হয়?
১০। তুমি কি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রেগে যাওয়ার জন্য আবার নিজের অপর প্রচণ্ড রাগ অনুভব করো?
যদি তোমার বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তরই 'হ্যাঁ' হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে তোমার রাগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা আছে এবং এ ব্যাপারে তোমাকে এখনই কিছু করতে হবে।
কেন রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে?
-----------------------------------------
অনেক কম বয়সে রাগ নিয়ন্ত্রনহীনতার সমস্যা হলে সেখান থেকে অনেক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাও হতে পারে। আবেগের সাথে কিন্তু তোমার শরীরের সম্পর্ক ওতপ্রোত। রাগের কারণে তোমার শরীরে এমন কিছু পরিবর্তন হয়, যা থেকে নিচের বিষয়গুলো ঘটতে পারে -
1) উচ্চ রক্তচাপ
2) হজমে সমস্যা
3) কোমরের নিম্নদেশে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা
4) হার্ট অ্যাটাক
5) ঠাণ্ডা ও সর্দি
তাছাড়া তোমাকে কিন্তু তোমার মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারেও চিন্তা করতে হবে। নিয়ন্ত্রনহীন রাগের কারণে বিষণ্ণতা, অস্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস, মাদকাসক্তি, কারো সাথে সম্পর্ক তৈরিতে সমস্যা এবং আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
যেসব কিশোর-কিশোরীর রাগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা থাকে তাদের কিন্তু বন্ধু সংখ্যাও খুব কম থাকে। তাদের আচরণ অনেক নেতিবাচক হয়, এবং পরীক্ষাতেও তারা ভালো গ্রেড পায় না। তাদের এরকম রাগের কারণে তারা অন্যের যথেষ্ট মনোযোগ পায় ঠিকই, কিন্তু তারপরও তারা সবসময় একা বোধ করে এবং অখুশি থাকে।
যদি তুমি প্রচণ্ড রাগের কারণে আক্রমনাত্নক আচরণ করো, তাহলে দেখবে তোমার বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সদস্যরা তোমার কারণে বেশ ভীত থাকছে। তারা হয়তো তোমার সাথে খোলামেলাভাবে কথাও বলতে পারবে না, এবং ধীরে ধীরে হয়তো তাদের সাথে তোমার দূরত্ব তৈরি হবে। যদি রাগের মাথায় জিনিসপত্র ছোঁড়াছুঁড়ির অভ্যাস থাকে তোমার, তাহলে কারো বিপদ ঘটিয়ে ফেলার আগেই কারো সাহায্য নাও।
কিভাবে বুঝবে যে তোমার রাগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে?
-------------------------------------------------------------------------
এবার একটু পেছনের কথা চিন্তা করো। এমন একটা ঘটনার কথা ভাবো, যেখানে তোমার প্রচণ্ড রাগ উঠেছিলো। তখন তোমার কেমন লেগেছিলো? কি এমন হয়েছিলো যে তোমার অত রাগ হয়েছিলো? রাগ হলে একেকজনের আচরণ একেকরকম হয়, কিন্তু কিছু বিষয়ে সাদৃশ্য থাকে, যেমন -
1) তোমার হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যায়
2) তোমার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত গতিতে চলতে থাকে
3) তোমার মুষ্টি বদ্ধ হয়ে যেতে থাকে
4) তোমার মনে হতে থাকে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং মনে হয় ঘামতে শুরু করবে
এভাবেই তোমার শরীর অনিয়ন্ত্রিত রাগের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে।
কিন্তু তুমি ভেবে দেখো, নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতেই কিন্তু তোমার এমন রাগ হয় যে তুমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলো। তুমি যদি সেটা চিহ্নিত করতে পারো, তাহলে কিন্তু সেরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সেই ঘটনা তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করার আগেই তুমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসতে পারবে। তোমাকে এটা মনে রাখতে হবে যে তোমার চিন্তা, অবস্থা, আচরণ সবকিছুই পরস্পর সম্পর্কিত। তুমি যেটা চিন্তা করো, সেটা তোমার অনুভূতিকে প্রভাবিত করে, আবার সেই অনুভূতিই কিন্তু তোমার আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে। আবার উল্টোভাবে, তোমার আচরণের কারণেও কিন্তু তোমার চিন্তায় প্রভাব পড়তে পারে, আবার তা থেকে তোমার অনুভূতিও প্রভাবিত হতে পারে। যেহেতু, এগুলা সবই একটা আরেকটার সাথে সংযুক্ত, একটাতে পরিবর্তন আনলেই কিন্তু অন্যগুলোর মধ্যেও বড় পরিবর্তন আসবে - সেটা চিন্তাই হোক, অনুভূতিই হোক আর আচরণই হোক।
কিভাবে তুমি রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারো ?
-----------------------------------------------------
যখনি তোমার মনে হবে রাগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং শরীরের ভেতরে বিক্রিয়াগুলো শুরু হয়ে গেছে, তখন যা যা করতে পারো -
1) ধীরে এবং লম্বা করে শ্বাস নাও এবং তার চেয়ে বেশি সময় নিয়ে শ্বাস ছাড়ো। তোমার শ্বাস-প্রশ্বাস শিথিল করতে এটা সাহায্য করবে।
2) এক থেকে দশ পর্যন্ত গোনো। এটা তোমাকে শান্ত হবার সময় দেবে এবং সেই সময়টুকুতে তুমি পরিষ্কারভাবে চিন্তাও করতে পারবে,
3) মনে মনে বার বার বলো, ' আমি নিয়ন্ত্রণে আছি'।
4) শরীরের পেশীগুলোকে শক্ত করার চেষ্টা করো এবং নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করো। তাতে কি পরিবর্তন হচ্ছে সেটা অনুভব করার চেষ্টা করো।
5) চোখ বন্ধ করে পছন্দের কোনো ব্যক্তি, স্থান বা এমন কিছুর কথা ভাবো যা তোমাকে আনন্দ দেয়। এটা তোমাকে শান্ত হতে সাহায্য করবে।
6) যে কারণে রাগ হচ্ছে, ওই পরিস্থিতি থেকেই বের হয়ে আসো। সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নাও। তাতেও হয়তো তোমার রাগ কিছুটা প্রশমিত হবে।
7) শারীরিক যে টেনশনটা হচ্ছে সেটাকে ছেড়ে দাও। যদি তোমার মনে হয় যে কোনো কিছুতে আঘাত করলে তোমার ভালো লাগবে, তাহলে ম্যাট্রেসে আঘাত করো। যদি তোমার প্রচণ্ড চিৎকার করতে ইচ্ছা হয়, তাহলে বালিশে মুখ গুঁজে চিৎকার করতে পারো।
যদি তোমার দীর্ঘমেয়াদী সাহায্যের প্রয়োজন হয়
----------------------------------------------------------------
অনেকেরই এটা মেনে নিতে সমস্যা হয় যে তাদের অনিয়ন্ত্রিত রাগের সমস্যা আছে এবং তারা ক্রমাগতই আরও ক্রোধাতুর ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে থাকে। তোমার যদি এরকম সমস্যা থাকে এবং সেটা যদি তুমি চিহ্নিত করতে পারো, এবং রাগের লক্ষণগুলোও যদি ধরে ফেলতে পারো, তাহলে কিন্তু তুমি নিজেই নিজেকে সাহায্য করতে পারো এবং কাউকে বলতেও পারো তোমাকে নির্দেশনা দেবার জন্য।
কিছু পরামর্শ, যা তোমার জন্য সহায়ক হতে পারে -
1) ব্যায়াম - তোমার মানসিক চাপ কমানোর জন্য দৌড়ানো, হাঁটা, সাঁতার কাটা, যোগব্যায়াম কিংবা অন্যান্য মেডিটেশন টেকনিক সহায়ক হতে পারে। ব্যায়ামের ফলে শরীর থেকে এনডোরফিনস (Endorphines) নিঃসৃত হয়, যা এরকম মুহুর্তে তোমার শরীরকে শিথিল করতে সাহায্য করবে এবং তোমার রাগকে প্রশমিত করবে।
2) নিজের প্রতি যত্নশীল হও - প্রতিদিন নিজের বিশ্রামের জন্য একটু হলেও সময় বের করো এবং যথেষ্ট পরিমাণ ঘুমাও। মাদক বা অ্যালকোহল এর ব্যবহার কিন্তু তোমার রাগের অনুভূতিকে না কমিয়ে বরং আরও ঘনীভূতই করবে কেবল। সে কারণেই যত রাগই হোক, অগ্রহণযোগ্য কিছু করা যাবে না মোটেই।
3) সৃষ্টিশীল কিছু করো - লেখালেখি, গান, নাচ বা ছবি আঁকা তোমার টেনশনকে প্রশমিত করার জন্য সহায়ক হতে পারে।
4) মন খুলে কথা বলো - এরকম হলে আস্থাশীল কারো সাথে কথা বলো বা দেখা করো। সে তোমার বন্ধু হতে পারে, আত্মীয় হতে পারে, শিক্ষক হতে পারে এমনকি তোমার পরিচিত এমন কেউ হতে পারে যাকে তুমি ভালো শ্রোতা বলে ভাবো। এমনকি, তুমি চাইলে কোনো কাউন্সেলরের সাথে কথা বলতে পারো, তোমার অনুভূতিকে বুঝে নিয়ে তার নিয়ন্ত্রণের জন্য কি কৌশল অবলম্বন করা উচিত সে ব্যাপারে তার কাছ থেকে সাহায্য নিতে পারো। তোমার অনুভূতিগুলো আরেকজন বন্ধুকে জানালেও তোমার উপকার হতে পারে। তাতে হয়তো তুমি ঘটনার ভিন্ন একটা দৃষ্টিভঙ্গি পাবে।
5) দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টাও - 'এটা একদমই ঠিক হলো না', কিংবা ' এরকম মানুষের চোখের সামনে থাকাই ঠিক না' জাতীয় চিন্তা- ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করো কারণ এগুলা পরিস্থিতিকে আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। এসব চিন্তা তোমাকে রাগের উৎসের দিকেই নিবিষ্ট করে রাখবে। বরং, এসব চিন্তা যদি মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারো, তাহলে দেখবে যে রাগ নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হয়ে গেছে।
6) 'সবসময়' (সবসময়ই তুমি এমন করো), ' কখনোই নয়' (কখনোই তুমি আমার কথা শোনো না) , ' উচিৎ/ উচিৎ নয়' (আমি যা চাই তোমার তাই করা উচিৎ/ আমার চোখের সামনেই তোমার থাকা উচিৎ নয়) , 'অবশ্যই/ অবশ্যই নয়' ( আমাকে অবশ্যই সময়মতো যেতে হবে/ আমি অবশ্যই সময়মত যেতে পারবো না) জাতীয় শব্দগুলো যত কম ব্যবহার করা যায় ততোই ভালো।
7) বিশ্রাম নাও - রাগের কারণে আমাদের অনেক শক্তি ক্ষয় হয় এবং তা আমাদেরকে ক্লান্ত করে দেয়। এক্ষেত্রে একটু বিশ্রাম নেয়া, ঘুমানো বা তাড়াতাড়ি শুতে যাওয়া সহায়ক হতে পারে। ঘুম আমাদেরকে কোনো কিছুতে নিবিষ্ট হতে এবং অনুভূতিকে সামাল দিতে সাহায্য করে।
8) মজা করো - যখন তোমার অনেক রাগ হবে, তখন রাগের পরিস্থিতি বা বিষয়টাকেই কৌতুককর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে পারলে রাগ নিয়ন্ত্রণ অনেক সহজ হয়ে যায়। যেমন, মনে করো, তোমার খুবই একটা বাজে দিন গেলো। সেদিন হয়তো তোমার কোনো কাজই ঠিকমতো হয়নি। যেখানে তুমি যদি নিজেকে পরিস্থিতির শিকার ভেবে আরও রাগ না করে উল্টো নিজেকে একটা মজার চরিত্র হিসেবে ভেবে নিতে পারো, তাহলেই কিন্তু রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন ধরো, তুমি নিজেকে সাউথ পার্ক-এর একজন চরিত্র হিসেবে ভাবো। তাহলে ওরকম পরিস্থিতিতে কি হবে? তখন যদি কোনোকিছুই ঠিকমতো না হয় এবং সারাদিন এরকম চলতেই থাকে, তাহলে তুমি হতাশ হবার বদলে সেটাকে একটা কৌতুক হিসেবে দেখবে এবং তাতে তোমার প্রচণ্ড রকমের রাগও হবে না। যদি এভাবে ভাবতে পারো যে জীবনে কোনো কিছুকেই খুব সিরিয়াসভাবে নেয়ার কিছু নেই, তাহলেই কিন্তু খুব সহজ দৃষ্টিভঙ্গিতে সবকিছু দেখা যায়।
[ইন্টারনেট হতে সংগ্রহীত]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন